আন্তর্জাতিক ডেস্ক :বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বেচাকেনার পেছনে রয়েছে জটিল ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমীকরণ। রয়েছে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত বিশ্বের প্রভাবশালী অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি মদত। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা।
ইউরোপে বেড়েছে অস্ত্র বাণিজ্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘ সময় অপেক্ষাকৃত নিরুপদ্রব সময় পার করলেও রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের পর থেকেই ইউরোপে বেড়েছে অস্ত্র কেনাবেচার হার। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে অস্ত্রের বাণিজ্য কয়েক গুণ বেড়েছে ইউরোপে। সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি) গত পাঁচ বছরের অস্ত্র ব্যবসা নিয়ে সম্প্রতি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এতে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে বিশ্বে অস্ত্র ব্যবসা ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমলেও ইউরোপে ব্যবসা বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ।
ইউরোপে অস্ত্র বাণিজ্যের পেছনে রাশিয়া ভীতি
সিপরির সবশেষ রিপোর্টে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তথ্য আছে। অর্থাৎ, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর কিছুদিন আগপর্যন্ত তথ্য আছে সেখানে। ফলে ধরেই নেয়া যায়, গত কয়েক মাসে ইউরোপের অস্ত্র ব্যবসা আরও বেড়েছে।
রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ইউরোপে অস্ত্র ব্যবসা বাড়তে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকে। ওই বছর ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। মূলত এ ঘটনাই বাড়িয়ে তোলে ইউরোপের নিরাপত্তা উদ্বেগ। এর পরপরই ইউরোপের একাধিক দেশ সামরিক খাতের বাজেট বাড়িয়ে দেয়। ইউরোপের অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে তাই অনেকটাই জড়িয়ে রাশিয়া। গত কয়েক বছরে ইউরোপে রাশিয়ার আগ্রাসন যত বেড়েছে, অস্ত্রখাতে ব্যয়ও বেড়েছে সমানুপাতিক হারে।
ন্যাটোকে অস্ত্র বিক্রির কাজে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র
ইউরোপের রাশিয়াভীতির পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে। সিপরির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক অবনতি হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করেছে।
সুইডেনের প্রতিষ্ঠানটির মতে, রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাতের পূর্ণ সুবিধা নিচ্ছে মার্কিন অস্ত্র কোম্পানিগুলো। এশিয়া-আফ্রিকাসহ বিশ্বের সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলগুলোর থেকেও বেশি অস্ত্রের গন্তব্য এখন ইউরোপ।
অস্ত্র বাণিজ্যের ৭৮ শতাংশ ৫টি দেশের দখলে
২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যের ৭৮ শতাংশ ছিল মাত্র ৫টি দেশের দখলে। দেশগুলো হলো: যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও চীন। বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যের ওপর নজর রাখা আন্তর্জাতিক থিংকট্যাংক সিপরির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের ৩৯ শতাংশ অস্ত্র রফতানি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দখলে, ১৯ শতাংশ রাশিয়ার দখলে। ফ্রান্সের দখলে ছিল ১১ শতাংশ। চীনের দখলে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
অস্ত্র রফতানি বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র রফতানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র বিক্রির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওবামা প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় অস্ত্র রফতানিকে আরও গতিশীল করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অস্ত্র রফতানিতে তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো আপাতত কেউ নেই। ২০১৭-২১ মেয়াদে আমেরিকার অস্ত্র রফতানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। আবার মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় গ্রাহক সৌদি আরব। পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপেও বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রফতানি।
সামরিক খাতে বছরে ব্যয় ২ ট্রিলিয়ন ডলার
বিশ্বের অনেক দেশই অস্ত্র কেনার পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে। তবে খুব অল্প দেশেরই নিজের সামরিক শিল্পখাত রয়েছে। ফলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই অস্ত্র কিনতে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। সিপরির সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হয় দুই লাখ কোটি ডলার। এর মধ্যে অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয় ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র সাবমেরিনসহ অন্যান্য অস্ত্র কেনার পেছনে।
শীর্ষ অস্ত্র বিক্রেতা কোম্পানির সব কটিই যুক্তরাষ্ট্রের
বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ অস্ত্র বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রেতা ৫টি কোম্পানিই যুক্তরাষ্ট্রের। যার মধ্যে রয়েছে লকহিড মার্টিন, বোয়িং এবং নর্থরোপ গ্রুম্যানের মতো কোম্পানি।
সিপরি ২০২০ সালের বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে শীর্ষ ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে বিক্রি করে ৬৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র। এক বছরে তাদের অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের রেইথেওন টেকনোলজিস। ২০২০ সালে কোম্পানিটি বিক্রি করে ৩৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম। তিনে আছে আরেক মার্কিন কোম্পানি বোয়িং। বেসামরিক ও যাত্রীবাহী বিমান তৈরির পাশাপাশি বোয়িং বিশ্বের নামকরা অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও। করোনা মহামারির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করা অস্ত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং।
শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক সৌদি আরব ও ভারত
ভারত, সৌদি আরব, মিশর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের শীর্ষ দশ অস্ত্র আমদানিকারক। এই দেশগুলো বিশ্বের ৫৫ শতাংশ অস্ত্র আমদানি করে থাকে। বিশ্বের বাকি সব কটি দেশ মিলে কেনে বাকি ৪৫ শতাংশ অস্ত্র।
২০১৭ থেকে ২০২১–এই পাঁচ বছরে অস্ত্র আমদানির দিক থেকে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে যৌথভাবে প্রথম স্থান সৌদি আরব ও ভারতের। দুটি দেশ আমদানি করেছে বিশ্বের মোট অস্ত্রের ১১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মিশর ৫ দশমিক ৭ শতাংশ ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়া ৫ দশমিক ৪ শতাংশ অস্ত্র আমদানি করেছে।
Array