আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য
হজরত আদম (আ.)–এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও অবনমন—সব ঘটনাই ঘটেছিল আশুরায়। হজরত নুহ (আ.)–এর নৌযানের যাত্রারম্ভ ও বন্যাবস্থার সমাপ্তি ছিল আশুরাকেন্দ্রিক। নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মুক্তি পাওয়া, হজরত ইউনুছ (আ.)–এর মাছের পেট থেকে মুক্ত হওয়া, হজরত দাউদ (আ.)–এর জালুত বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করা, হজরত আইয়ুব (আ.)–এর ১৮ বছর অসুস্থতার পর রোগমুক্ত হওয়া, হজরত ঈসা (আ.)–এর আসমানে উত্থানসহ বহু ঐতিহাসিক ঘটনার গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী এই আশুরা। (তাফসিরে তাবারি, ইবনে জারির) কোরআন করিমে রয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২, এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬) হাদিস শরিফে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ‘অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস’ বলতে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব মাসকে বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬)
আশুরার আমল ও ফজিলত
আশুরার রোজা সব নবী-রাসুলের আমলেই ছিল। নবীজি (সা.) মক্কা মুকাররমায় থাকতে আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এদিনে রোজা রাখছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) জানতে পারলেন, এদিনে মুসা (আ.) সিনাই পর্বতে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ করেন। এদিনেই তিনি বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কয়েদখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং এদিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যায়। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এদিন রোজা রাখে। মহানবী (সা.) বললেন, মুসা (আ.)–এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ। অতঃপর তিনি মহররমের ৯-১০ অথবা ১০-১১ মিলিয়ে দুটি রোজা রাখতে বললেন, যাতে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ব্যতীত অন্য যেকোনো মাস অপেক্ষা উত্তম। (মুসলিম ও আবুদাউদ)
রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী আল্লাহ তাআলা এর অসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘রমজানের রোজার পর মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ, যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জত নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।’ (তিরমিজি ও মুসনাদে আহমাদ)।
উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা (রা.) বলেন, রাসুলে আকরাম (সা.) চারটি কাজ জীবনে কখনো পরিত্যাগ করেননি। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, আইয়ামে বিদের রোজা, ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকআত সুন্নত নামাজ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করবে; আল্লাহ তাআলা সারা বছরের জন্য তার প্রাচুর্য বাড়িয়ে দেবেন।’ বিশিষ্ট তাবিয়ি হজরত সুফিয়ান ছাওরি (র.) বলেন, ‘আমরা এটি পরীক্ষা করেছি এবং এর যথার্থতা পেয়েছি।’ (মিশকাত: ১৭০; ফয়জুল কালাম: ৫০১, পৃষ্ঠা: ৩৪৯; বায়হাকি ও রাজিন)
মহররম নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার
সাধারণ মানুষের মধ্যে মহররম মাস সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন এ মাসে বিয়েশাদি না করা, নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা, কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা, গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা, পান না খাওয়া, নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক পরিধান না করা, সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা, সব ধরনের আনন্দ–উৎসব পরিহার করা—এসবই কুসংস্কার।
কারবালার চেতনা
হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)–এর ফোরাতের তীরে কারবালার প্রান্তরে আত্মদান মূলত অসত্য, অসুন্দর, অন্যায় ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে সত্য–সুন্দর–ন্যায় ও কল্যাণের অনন্তকালের জন্য আদর্শিক বিজয়ের চেতনা। কারবালার চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনা। মহররম মাস আসবে প্রতিবছর ঘুরে, আশুরা আসবে বারবার ঘুরেফিরে, কারবালার চেতনা জাগ্রত হবে প্রতিটি সংকট মুহূর্তে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘জালিম শাসকের সম্মুখে হক কথা বলা উত্তম জিহাদ।’ (বুখারি ও তিরমিজি)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম। smusmangonee@gmail.com